অনলাইন ডেস্কঃ
করোনাকালে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ আগের চেয়ে কমেছে। তবু ‘মানবিকতা’ দেখাচ্ছে না স্কুল-কলেজগুলো। তারা টিউশন ফি গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে আগের মতোই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান টিউশন ফি আদায়ে নানা ধরনের চাপও দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ অগ্রিম বেতন পরিশোধের নোটিশও দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিভাবকরা অর্ধেক বেতন নেওয়ার দাবি জানালেও তাতে সাড়া নেই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের।
গত ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এর পর থেকে দু-তিন মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। তবে জুন মাস থেকে নামিদামি প্রায় সব স্কুল-কলেজে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। মূলত শিক্ষকরা নিজেরাই বাড়িতে বসে ইন্টারনেট খরচ করে স্বল্পসংখ্যক ক্লাস নিচ্ছেন। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কোনো খরচই করতে হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নামিদামি প্রায় সব স্কুল-কলেজেই খণ্ডকালীন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এ ছাড়া দৈনিক ভিত্তিতে কর্মচারীরা কাজ করেন, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে যাঁদের অনেকেরই বেতন বন্ধ করে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ী শিক্ষকদেরও উৎসব বোনাসসহ বিভিন্ন ধরনের বিল প্রদান বন্ধ রেখেছে। স্কুলের বিদ্যুৎ ও পানির বিল সাশ্রয় হচ্ছে। এ ছাড়া আইটি, ল্যাবসহ নানা ধরনের খরচ কমেছে। এতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ খরচ কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা।
তবে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর প্রথম দুই মাস স্কুল-কলেজগুলো বেতনের জন্য তেমন চাপ না দিলেও গত মে মাস থেকে চাপাচাপি শুরু করে।
ওয়েবসাইটে নোটিশ দেওয়া, বারবার এসএমএস পাঠানো এবং শিক্ষকরা অভিভাবকদের একাধিকবার ফোন দিচ্ছেন। এমনকি বেতন পরিশোধ না করলে কিছু স্কুল অনলাইনে ক্লাসে যুক্ত হতে না দেওয়ার মতোও অমানবিকতা দেখাচ্ছে।
একাধিক নামিদামি স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নোটিশ ও এসএমএস দিলেই ৫০ শতাংশ অভিভাবক টিউশন ফি পরিশোধ করেছেন। এরপর শিক্ষকদের ফোন করার পর আরো ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অভিভাবক বেতন পরিশোধ করেছেন।
জানা যায়, রাজধানীতে অর্ধশতাধিক নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেক জেলা শহরে দু-তিনটি করে একই মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের টিউশন ফি পেতে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ ছাড়া দেশের প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত এবং এক হাজার ২০০ স্কুল-কলেজ সরকারি, যারা সরকার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছে। তবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিন্ডারগার্টেন স্কুল-কলেজগুলোর অভিভাবকরা টিউশন ফি দিচ্ছেন না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা চরম কষ্টে দিন যাপন করছেন।
রাজধানীর উত্তরার একটি নামি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় শতভাগ টিউশন ফি আদায়ের পরও গত ঈদে শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতা দেয়নি, এমনকি আসন্ন ঈদেও দেবে না বলে জানিয়েছে। পুরান ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ একাধিক অস্থায়ী কর্মচারীর বেতন বন্ধ রেখেছে। শিক্ষার্থীরা চার মাস ধরে স্কুলে না গেলেও রাজধানীর মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতি মাসের বেতনের সঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাবদ শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০ টাকা করে নিচ্ছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেশির ভাগ অভিভাবক জুন পর্যন্ত বেতন পরিশোধ করলেও জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের অগ্রিম বেতন প্রদানের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা করোনাকালে উচ্চ বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। স্কুলগুলোর শিক্ষাবর্ষ গত জুনে শেষ হওয়ার পর তারা জুলাইয়ের শুরুতে সব শিক্ষার্থীকেই পরের ক্লাসে উন্নীত করে। আগের বকেয়া বেতন পরিশোধ ও নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাসের বেতন না দিলে নতুন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নাম তুলছে না। ফলে অভিভাবকদের কষ্ট হলেও বেতন দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘করোনাকালে অনেক অভিভাবকই যাঁরা বেসরকারি চাকরি বা ছোটো ব্যবসা করেন, তাঁরা প্রচণ্ড সমস্যায় আছেন। এই সময়ে স্কুলগুলো কোনো ধরনের ছাড় দিচ্ছে না। আমরা ছয় মাসের সম্পূর্ণ বেতন মওকুফ বা পুরো বছরের অর্ধেক বেতন নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। স্কুলগুলোকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।’
তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, টিউশন ফি আদায় করেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। যাঁরা সচ্ছল অভিভাবক তাঁরা সবাই যদি বেতন পরিশোধ করে দিতেন, তাহলে যাঁরা সত্যিকার অর্থেই সমস্যায় আছেন তাঁদের ব্যাপারে ভাবতে পারত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীর অভিভাবক বেতন পরিশোধ করছেন না। জুন পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বেতন দিয়েছে, যা দিয়ে কোনোমতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন অব্যাহত রাখা হয়েছে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষকেই আরো মানবিক হতে হবে। অভিভাবকরা টিউশন ফি না দিলে শিক্ষকদের বেতন হবে না। আবার অভিভাবকরা টিকে থাকতে না পারলে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী পাবে কোথায়? তাই উভয়কেই উভয়ের কথা চিন্তা করতে হবে।’ সূত্রঃ কালের কন্ঠ।
Discussion about this post